
সুতরাং আমরা যেহেতু আল্লাহর রঙ্গে নিজেকে রাঙ্গানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সেহেতু আসুন আমরা জেনে নেই কীভাবে ঈদের সালাত আদায় করবো।
ঈদগাহে গিয়ে বড় জামায়াত করা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ থাকা সত্ত্বেও ছোট ছোট জামায়াত করা যাবে। আর ঈদগাহে অথবা মসজিদে ঈদের সালাত আদায় করার মাসয়ালা প্রায় সবার জানা।
ব্যতিক্রম হচ্ছে যদি কেউ বাড়ীতে ঈদের সালাত আদায় করতে চায় সেক্ষেত্রে ইসলাম কী বলে?
ইসলাম সার্বজনীন ও সময় উপযোগী ধর্ম। তাই ইসলামে এ বিষয়ে অত্যন্ত চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়।
সহীহ রেওয়ায়েতে প্রমাণিত হয়েছে যে, আনাস (রা.) ঈদের সালাত জামায়াতে না পাওয়ার পর তিনি ঘরে এসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এমনকি দাস-দাসীসহ তাকবীরের সাথে ঈদের জামায়াত করেন। তবে, সেখানে তিনি ঈদের খুতবা দেননি।
কোন এক সময়ে আনাস (রা.) এর দাস আব্দুল্লাহ বিন আবি উতবাহ দুই রাকায়াত ঈদের সালাতের ইমামতি করেছেন। বুখারী – ৯৮৭
এই আছার বা সাহাবার আমলের ওপর ভিত্তি করে মালেকী, শাফেয়ী ও হাম্বলী মাজহাবে ঘরে ঈদের সালাত আদায় করা যাবে বলে মতামত দেওয়া হয়েছে। মুখতাসারুল ঊম্মু মুযানী, ৮/১২৫ ও শারহুল খারশী, ২/১০৪।
হানাফী মাজহাবে বলা হয়েছে যে, যদি ইমামের সাথে ঈদের সালাত না আদায় করতে পারে তাহলে আলাদা বা একা তা আর আদায় করা যাবে না। আদ-দুররুল মোখতার ২/১৭৫।
এর পক্ষে হাদীসের কোন প্রমাণ না পাওয়া গেলেও যুক্তি হলো- ঈদ হলো ব্যাপক গোষ্ঠীয় ইবাদত, পারিবারিক নয়। ফলে, ঘরে তা আদায় করা যাবে না। ইমাম ইবনে তাইমিয়া (র.) ও ইবনে উসাইমিন (র.) হানাফী মাযহাবের পক্ষে মত দিয়েছেন। আশশারহুল মুমতি, ৫/১৫৬।
সউদী স্থায়ী ফতোয়া কমিটির ফতোয়া (৮/৩০৬) বলেছে যে, যদি কেউ ঈদের সালাতের জামায়াত না পায়, তিনি ঘরে বা অন্য কোথাও আবার আলাদা জামায়াত করতে পারবেন ঈদের অতিরিক্ত তাকবীর সহ। কিন্তু এখানে সালাতের পর ঈদের খুতবা দিবেন না। এই সালাতের জন্যে ইক্বামত দিতে হবে না কিন্তু কেরআত জোরে পড়বে। ঘরে ঈদের সালাত আদায় করলে আগে ঈদের সালাত পড়বেন এরপর এশরাকের সালাত পড়বেন। কারণ ঈদের দিনে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওসাল্লাম) ঐ দিনের সালাত শুরু করতেন ঈদের সালাত দিয়ে, এশরাকের সালাত নয়।
মিশরের গ্রান্ড মুফতিও ফতোয়া দিয়েছেন যে, এই বছর কোভিড -১৯ এর কারণে পরিবারের সদস্যরা নিজেরা ঘরেই ঈদের সালাত জামায়াতে আাদায় করতে পারবেন। কারণ এর পক্ষে সাহাবীদের আমল পাওয়া যায়।
আমরা তাহলে কোনটা আমল করব?(!)
এখানে আপনাদের কাছে ভিন্নভিন্ন মত উপস্থাপন করা হলো। আপনারাই সিদ্ধান্ত নিবেন কোনটা আমল করবেন। তবে, যেহেতু আনাস (রা.) নিজেই বাসায় পরিবারের লোকদেরকে নিয়ে ঈদের সালাত করেছেন বলে সহীহ হাদীসে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাই আমরাও চাইলে সে অনুযায়ী আমল করতে পারি।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।
এবার আসুন আমরা জেনে নেই ঈদের দিন আমরা কী কী কাজ করবো এবং একজন মুসলিম হিসাবে কী করা উচিত।
ঈদুল ফিতরের তারিখ –
রমযান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের এক তারিখে ঈদুল ফিতর পালন করা হয়। তবে আরবী পঞ্জিকা অনুসারে কোন অবস্থাতে রমযান মাস ৩০ দিনের বেশী হবে না। আর তা নির্ধারণ হবে চাঁদ দেখার উপর।
ঈদের আগের দিনের রাতটিকে লাইলাতুল জায়জা (পুরুস্কার রজনী) এবং চলতি ভাষায় ”চাঁদ রাত” বলা হয়। ঈদের চাঁদ স্বচক্ষে দেখে তবেই ঈদের ঘোষনা দেয়া ইসলামের বিধানের অংশ।
আধুনিক কালে অনেক দেশে গানিতিক হিসাবে ঈদের দিন নির্ধারন হলেও বাংলাদেশে ঈদের দিন নির্ধারন হয় দেশের কোথাও না কোথাও চাঁদ দর্শনের উপর জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটির সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে। তথাপি বাংলাদেশের কোথাও কোথাও মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে মিল রেখে রোযা পালন ও ঈদ উৎযাপন করে থাকে।
ঈদের দিনে করণীয় –
ঈদের দিন আতর বা সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত। এ দিন আমরা জামায়াতে মিলিত হই। তাই প্রত্যেক মুসলিমের উচিত, তার প্রতি আল্লাহর যে নেয়ামত তা প্রকাশ ও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করার জন্য নিজেকে সর্বোত্তম সাজে সজ্জিত করা। ইমাম মালেক (রহ.) বলেন, ‘আমি ওলামাদের কাছ থেকে শুনেছি তারা প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ব্যবহার ও সাজ-সজ্জাকে মোস্তাহাব বলেছেন।’ আল-মুগনি, ইবনে কুদামাহ
ঈদের দিনের সুন্নাতসমূহ –
১. অন্যদিনের তুলনায় সকালে ঘুম থেকে উঠা। বায়হাকি – ৬১২৬
২. মিসওয়াক করা। তাবয়ীনুল হাকায়েক – ১/৫৩৮
৩. গোসল করা। হাদিসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) দুই ঈদের দিন গোসল করতেন।মুসনাদে বাযযার – ৩৮৮০
ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি ঈদুল ফিতরের দিন ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। মুয়াত্তা ইমাম মালেক – ৬০৯
৪. শরীয়তসম্মত সাজসজ্জা করা। বুখারী – ৯৪৮
৫. সামর্থ অনুপাতে উত্তম পোশাক পরিধান করা। ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দু’ ঈদের দিনে সুন্দরতম পোশাক পরিধান করতেন। বায়হাকী – ১৯০১)
৬. সুগন্ধি ব্যবহার করা। মুস্তাদরাকে হাকেম – ৭৫৬০
৭. ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার আগে মিষ্টিজাতীয় কিছু খাওয়া যেমন – খেজুর। তবে ঈদুল আযহাতে কিছু না খেয়ে ঈদের নামাযের পর নিজের কুরবানীর গোশত আহার করা উত্তম। বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করীম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের নামাজের পূর্বে খেতেন না। সালাত থেকে ফিরে এসে কুরবানীর গোশত খেতেন। আহমদ – ১৪২২
আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ (সা.) ঈদুল ফিতরের দিন কয়েকটি খেজুর না খেয়ে বের হতেন না, আর খেজুর খেতেন বে-জোড় সংখ্যায়। বুখারী – ৯০০
৮. সকাল সকাল ঈদগাহে যাওয়া। আবু দাউদ – ১১৫৭
৯. ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে সদকায়ে ফিতর আদায় করা। ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) লোকদেরকে ঈদের নামাজের উদ্দেশ্যে বের হওয়ার পূর্বেই সাদকাতুল ফিত্র আদায় করার নির্দেশ দেন। বুখারী – ১৪২১
১০. পায়ে হেঁটে ঈদগাহে যাওয়া। আলী রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন : সুন্নাত হল ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। তিরমিযী – ১৮৭
১১. ঈদের নামায ঈদগাহে আদায় করা, বিনা অপরাগতায় মসজিদে আদায় না করা। বুখারী – ৯৫৬, আবু দাউদ – ১১৫৮
১২. যে রাস্তায় ঈদগাহে যাবে, সে রাস্তা দিয়ে না এসে সম্ভব হলে অন্য রাস্তা দিয়ে ফেরা। বুখারী – ৯৮৬
১৩. ঈদুল ফিতরে ঈদগাহে যাবার সময় আস্তে আস্তে এই তাকবীর পড়তে থাকাঃ
اللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ، وَاللَّهُ أَكْبَرُ اللَّهُ أَكْبَرُ وَلِلَّهِ الْحَمْدُ
তবে ঈদুল আযহায় যাবার সময় পথে এ তাকবীর আওয়াজ করে পড়তে হবে।মুস্তাদরাকে হাকেম
ঈদ সংক্রান্ত কতিপয় বিধান নিম্নে অতি সংক্ষেপে কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে আলোচনা করার চেষ্টা করব যাতে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের নির্দেশিত পদ্ধতি অনুসারে আমরা আমাদের ঈদ উদযাপন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারি :
১. ঈদের দিন রোযা রাখা নিষেধ – প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা এ দু’দিন রোযা রাখতে নিষেধ করেছেন। বুখারী – ১৮৫৫
২. ঈদের রাত থেকে তাকবীর পাঠ করা – ঈদের রাতের সূর্য ডুবার পর থেকে আরম্ভ করে ঈদের নামায পড়া পর্যন্ত এ তাকবীর পড়তে হবে। পুরুষগণ মসজিদ, হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট তথা সর্বত্র উচ্চস্বরে তাকবীর পাঠ করবে। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন ঈদের আনন্দ প্রকাশ করা হয় অন্যদিকে আল্লাহর আনুগত্যের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। তাকবীর পড়ার নিয়ম হল, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবর ওয়ালিল্লাহিল হামদ্।
ﻭَﻟِﺘُﻜْﻤِﻠُﻮﺍ ﺍﻟْﻌِﺪَّﺓَ ﻭَﻟِﺘُﻜَﺒِّﺮُﻭﺍ ﺍﻟﻠَّﻪَ ﻋَﻠَﻰ ﻣَﺎ ﻫَﺪَﺍﻛُﻢْ ﻭَﻟَﻌَﻠَّﻜُﻢْ ﺗَﺸْﻜُﺮُﻭﻥ
َ”আর যেন তোমরা নির্ধারিত সংখ্যা পূরণ করতে পার এবং তোমাদেরকে যে সুপথ দেখিয়েছেন, তার জন্যে তোমরা আল্লাহর মমত্ব প্রকাশ কর এবং তাঁর কৃতজ্ঞতা হও।” সূরা বাকারা – ১৮৫
এই আয়াত থেকে প্রমাণিত হয়, ঈদের উদ্দেশ্য হল দুটি :
১. আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা।
২. আল্লাহ যে নেয়ামত দান করেছেন তার জন্য আল্লাহর কৃতজ্ঞতা আদায় করা।
অথচ ঈদের দিনেও অনেকে নামায পড়ে না।
আমি নতুন জামা পড়ে ঈদ উৎযাপন করছি অপর দিকে আমার প্রতিবেশীরা নতুন জামা তো দূরের কথা ঈদের দিনে কি খাবে সেটাও তারা জানে না। অথচ আমরা তাদের কোন খোঁজ-খবট নিচ্ছিনা।
চলুল কিছু অঙ্গীকার নিয়ে ঈদুল ফিতরের পথ চলা শুরু করি –
১. জীবনে আর কোন গুনাহের কাজ করবো না।
২. সর্বদা আল্লাহর নির্দেশিত পথে নিজকে পরিচালিত করবো।
৩. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বেই আত্মীয় প্রতিবেশীদের খোঁজ-খবর নিবো।
৪. সবার মাঝে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো।
৫. বিশ্বের নির্যাতিত মুসলিমদের জন্য দোয়া করবো।
সর্বোপরি ঈদ উৎযাপন হোক এভাবে –
দুশমনও হোক বন্ধু আজি
মিলাক বুকে বুক
সবার ছোঁয়ায় সবার দোয়ায়
ঘুচুক সকল দুখ।
ঈদুল ফিতর ঈদুল ফিতর
স্বপ্ন সুখের নদী
সব মানুষের দিলের ভেতর
বহুক নিরবধি।